আন্তর্জাতিক ডেস্ক
প্রকাশিত: ১২/০৩/২০২৫ ১০:৩২ এএম , আপডেট: ১২/০৩/২০২৫ ১০:৩৭ এএম

মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ভেঙে পড়ায় সেখানে ভয়াবহ বিপর্যয়ের আশঙ্কা করছে জাতিসংঘ।

সংস্থাটি বাংলাদেশকে বলছে, রাখাইনের দুর্ভিক্ষ মোকাবিলা করা না গেলে এবার শুধু রোহিঙ্গা নয়, সেখানে বসবাসরত বাকি জনগোষ্ঠী সীমান্ত ডিঙাতে পারে।

তাই সেখানকার সম্ভাব্য দুর্ভিক্ষ মোকাবিলায় বাংলাদেশের সহযোগিতা চাইছে জাতিসংঘ। তবে সংস্থাটির এ আহ্বানকে ইতিবাচক মনে করছে না ঢাকা।

নিরাপত্তাসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে এ প্রস্তাবকে ঝুঁকি হিসেবে বিবেচনা করছে।

গত অক্টোবরে জাতিসংঘের উন্নয়ন প্রকল্প (ইউএনডিপি) রাখাইন পরিস্থিতি নিয়ে ১২ পৃষ্ঠার একটি প্রতিবেদন তৈরি করে। ওই প্রতিবেদনে রাখাইনের অর্থনৈতিক পরিস্থিতির অবনতির কথা উল্লেখ করা হয়।

রাখাইনের পণ্য প্রবেশের জন্য আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ সীমান্ত বন্ধ রয়েছে, আয়ের কোনো উৎস নেই, ভয়াবহ মূল্যস্ফীতি, নেমেছে অভ্যন্তরীণ খাদ্য উৎপাদনে ধস; জরুরি সেবা ও সামাজিক সুরক্ষায় দেখা দিয়েছে ঘাটতি।

জাতিসংঘ আশঙ্কা করছে, কয়েক মাসের মধ্যে সেখানে ঝুঁকিতে থাকা জনগোষ্ঠীর পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মার্চ কিংবা এপ্রিলের মধ্যে রাখাইনে দুর্ভিক্ষ আঘাত হানতে পারে।

জাতিসংঘ ইতোমধ্যে রাখাইনের যুদ্ধ পরিস্থিতিসহ সার্বিক বিষয় বাংলাদেশকে জানিয়েছে। তারা বাংলাদেশ হয়ে রাখাইনে সহায়তা পাঠাতে চায়।

ইতোমধ্যে কক্সবাজার হয়ে আন্তর্জাতিক সীমান্ত দিয়ে সহায়তার একটি চালান সেখানে পাঠিয়েছে জাতিসংঘ। তবে দ্বিতীয় চালান পাঠাতে গিয়ে সমস্যায় পড়ে সংস্থাটি।

দ্বিতীয় চালানটি আর বাংলাদেশ অতিক্রম করতে দেয়নি সরকার। দীর্ঘদিন ধরেই রাখাইনে সহায়তা দিতে বাংলাদেশকে ব্যবহারের আহ্বান জানিয়ে আসছে জাতিসংঘ।

প্রতিবেদনে বাংলাদেশ সীমান্ত ব্যবহার করে দুই দেশের ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে সরাসরি পণ্য সরবরাহের সুপারিশ করা হয়।

এদিকে প্রধান উপদেষ্টার রোহিঙ্গা সমস্যা ও অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত বিষয়াবলি-সংক্রান্ত হাই-রিপ্রেজেন্টেটিভ ড. খলিলুর রহমান সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে জানিয়েছেন, বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যকার সীমান্তে অপরাধ দমনসহ সার্বভৌম রক্ষায় আরাকান আর্মির সঙ্গে কাজ করতে হবে।

কারণ রাখাইনে একটি সংকট পরিস্থিতি চলছে। মার্চ বা এপ্রিলে সেখানে দুর্ভিক্ষ আসতে পারে। তখন সেখান থেকে আরও রাখাইন অধিবাসীদের বাংলাদেশে ঢোকার শঙ্কা রয়েছে।

তবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিষয়টিকে দেখছে ভিন্নভাবে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, রাখাইনে যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে, তা অস্বীকার করার উপায় নেই।

তবে এ ধরনের পরিস্থিতিতে শুধু বাংলাদেশকেই এগিয়ে আসতে বলা হয়। দায়ভার যেন শুধু বাংলাদেশের। অঞ্চলের বাকি দেশগুলোর কোনো দায় নেই।

এমনিতে নিজস্ব শত প্রতিকূলতার মধ্যে ১০ লাখের ওপর রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক, সামাজিক, পরিবেশ ও নিরাপত্তা সংক্রান্ত চাপে রয়েছে।

এর মধ্যে আন্তর্জাতিক অঙ্গন ঝোঝা চাপাতে থাকবে, তা ভালোভাবে নিচ্ছে না বাংলাদেশ।

তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশ থেকে ত্রাণ পাঠানো শুরু করলে সেখানকার মানুষ পর্যাপ্ত সহায়তা না পেয়ে ত্রাণের উৎসে চলে আসার শঙ্কা রয়েছে। এ ছাড়া রাখাইন সীমান্তে এখন সরকারি কোনো বাহিনী দায়িত্বে নেই। ফলে সেখানে কোনো ধরনের দরকষাকষি বা লেনদেনে ঝুঁকি রয়েছে।

প্রথমত ত্রাণ রাখাইনের অধিবাসী পর্যন্ত পৌঁছাবে– এর নিশ্চয়তা নেই। আর আরাকান আর্মির মতো ননস্টেট অ্যাক্টরদের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক কোনো সম্পর্কে গেলে নিরাপত্তা ঝুঁকি থেকে যায়।

জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থা ইউএনএইচসিআরের তথ্য অনুযায়ী, এখন মিয়ানমারজুড়েই মানুষ বাস্তুচ্যুত অবস্থায় রয়েছে। ২০২১ সাল থেকে গত ৬ জানুয়ারি পর্যন্ত দেশটিতে ৩২ লাখ ৪৫ হাজার মানুষ অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত।

এর মধ্যে প্রায় ৪ লাখ ১৫ হাজার রাখাইন রাজ্যের। আর বাস্তুচ্যুত হয়ে প্রতিবেশী দেশ ভারতে পার হয়েছে ৭১ হাজার, এদের সবই প্রায় রাখাইনের।

গত এক বছরে বাংলাদেশে কী পরিমাণ রোহিঙ্গা নতুন করে ঢুকেছে, তা জাতিসংঘের হিসাবে তুলে ধরা হয়নি। বাংলাদেশ সরকার এতে আপত্তি জানালে সংশোধন আনে ইউএনএইচসিআর।

গত এক বছরে প্রায় ৬২ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে ঢুকেছে বলে ধারণা সরকারের। বর্তমানে রাখাইনে কী পরিমাণ মানুষ আছে, এর সুস্পষ্ট ধারণা পাওয়া না গেলেও জাতিসংঘ থেকে রোহিঙ্গা বাদে আরও ১২ লাখ রাখাইন অধিবাসী বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করতে পারে বলে আশঙ্কা করা হয়েছে।

নাম না প্রকাশের শর্তে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, প্রতিবেশী ভারতকেও তো জাতিসংঘ বলতে পারে। তবে ওইখানে সুবিধা করতে পারবে না জেনে সব আবদার বাংলাদেশকে করছে।

বাংলাদেশেরও প্রতিবেশী দেশকে সহযোগিতা করার ক্ষেত্রে আপত্তি নেই। তবে সেটা অবশ্যই নিজ স্বার্থ ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা করে করতে হবে।

তিনি বলেন, বাংলাদেশের সঙ্গে জাতিসংঘ মহাসচিবের আসন্ন বৈঠকে বিষয়টি তোলা হলে বাংলাদেশের অবস্থান জানিয়ে দেওয়া হবে।

আগামী বৃহস্পতিবার ঢাকা আসছেন জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস। ভিভিআইপি এ সফরে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে তাঁকে স্বাগত জানাবেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন। বিমানবন্দরের আনুষ্ঠানিকতা শেষে মহাসচিব সরাসরি হোটেলে যাবেন।

শুক্রবার সকালে মহাসচিবের অবস্থানরত হোটেলে প্রথমে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা ও প্রধান উপদেষ্টার রোহিঙ্গা সমস্যা ও অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত বিষয়াবলি-সংক্রান্ত হাই-রিপ্রেজেন্টেটিভের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করবেন।

এর পর প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠক করবেন আন্তোনিও গুতেরেস।

বৈঠক শেষে অভ্যন্তরীণ বিমানবন্দর হয়ে বাণিজ্যিক একটি ফ্লাইটে কক্সবাজারে যাবেন তিনি। এ সময় প্রধান উপদেষ্টা তাঁর সফরসঙ্গী হবেন। কক্সবাজারে তাদের স্বাগত জানাবেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিষয় উপদেষ্টা। সেখান থেকে তারা রোহিঙ্গা ক্যাম্পে পরিদর্শনে যাবেন।

রোহিঙ্গা ক্যাম্পে জাতিসংঘের বাংলাদেশে কাজ করা বিভিন্ন সংস্থা নিজ নিজ কার্যক্রম সম্পর্কে জাতিসংঘ মহাসচিবকে জানাবেন। সেদিন রাতে কক্সবাজার থেকে ঢাকার উদ্দেশে রওনা দেবেন তারা।

আগামী শনিবার ঢাকায় জাতিসংঘের কার্যালয়ে যাবেন আন্তোনিও গুতেরেস। সেখানে জাতিসংঘের সব কর্মীর সঙ্গে মতবিনিময় করবেন তিনি।

এর পর সেখান থেকে দুপুরে হোটেলে ফিরে গোলটেবিল বৈঠকে যোগ দেবেন গুতেরেজ। পরে সেখানে বাংলাদেশে যুবসমাজ ও নাগরিক প্রতিনিধির সঙ্গে মতবিনিময় করবেন তিনি।

এদিন বিকেলে একটি যৌথ প্রেস ব্রিফিং হওয়ার কথা রয়েছে। আর সন্ধ্যায় প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস আন্তোনিও গুতেরেসের সৌজন্যে ইফতার ও নৈশভোজের আয়োজন করেছেন। আগামী রোববার সকালে ঢাকা ছাড়ার কথা রয়েছে আন্তোনিও গুতেরেসের।

বাংলাদেশে জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারী গোয়েন লুইস বলেন, এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ সফর। প্রধান উপদেষ্টার আমন্ত্রণে তিনি রমজানে সংহতি জানাতে বাংলাদেশে আসছেন। প্রতিবছর তিনি রমজানে মুসলিম দেশগুলোতে সফর করে থাকেন। এ ছাড়া সফরে তিনি রোহিঙ্গা নিয়ে আলোচনা করবেন। সেখানে আন্তর্জাতিক সহায়তার বিষয়টি উঠে আসবে।

প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকে বাংলাদেশে সংস্কার, নির্বাচন এবং এর সহযোগিতা নিয়ে আলোচনা হবে কিনা– জানতে চাইলে তিনি বলেন, জাতিসংঘ বাংলাদেশের বিভিন্ন সরকারের সময়ে বাংলাদেশির পাশে থেকেছে। ফলে জাতিসংঘের সহযোগিতা ও সংহতি চলবে। কী ধরনের সহযোগিতা চাওয়া হবে এবং অগ্রাধিকার বিষয়গুলো কী, তা বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার বা আগামীতে নির্বাচিত সরকার জাতিসংঘকে জানাবে। জাতিসংঘ বাংলাদেশের সঙ্গে কাজ করতে প্রস্তুত।

প্রসঙ্গত, সম্প্রতি জাতিসংঘ মহাসচিব প্রধান উপদেষ্টাকে লেখা এক চিঠিতে বাংলাদেশে ট্রানজিশন প্রক্রিয়ায় সহযোগিতা ও সংহতির কথা পুনর্ব্যক্ত করেছিলেন।

পাঠকের মতামত

আওয়ামী লীগের প্রায় ৪৫ হাজার নেতাকর্মী এখন ভারতে অবস্থান করছেন: গৌতম লাহিড়ী

বিশিষ্ট প্রবাসী সাংবাদিক জুলকার নাইন সায়ের এক ফেসবুক পোস্টের মাধ্যমে জানিয়েছেন,সম্প্রতি ভারতের দিল্লির প্রেস ক্লাব ...

সুপ্রিম কোর্টের ঐতিহাসিক রায় স্কুলে ভর্তি হতে পারবে রোহিঙ্গা শিক্ষার্থীরা

ভারতের সুপ্রিম কোর্টের এক ঐতিহাসিক রায়ের ফলে দেশটির রোহিঙ্গা শরণার্থীরা সরকারি স্কুলে ভর্তি হওয়ার সুযোগ ...